সোমবার, ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সাহসী কলম যোদ্ধা ইয়াহিয়া নয়নের আত্মকথন-৩

শেয়ার করুনঃ

১৯৮৫ সালে আমার জন্মস্থান পাবনার ঈশ্বরদী থেকে প্রথম একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জংশন’ প্রকাশিত হয়।ওই পত্রিকার জন্ম থেকে ছিলাম, বার্তা সম্পাদক, পরে সম্পাদক।
তার আগে ঢাকার কাগজগুলোতে শখের সাংবাদিকতা করেছি। ১৯৮৮ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি। এসেই তখনকার প্রচার বহুল ‘সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ’ পত্রিকায় সহসম্পাদক এবং প্রতিবেদক হিসেবে যোগদান করি।
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রচ্ছদ রচনা এবং অন্যান্য লেখালিখির জন্য সাংবাদিক মহলে পরিচিত হয়ে উঠি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, বিচিন্তা এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা কুরিয়ার-এ নিয়মিত লিখতে থাকি।

দৈনিক বাংলার বাণীতে আমার লেখা প্রতিবেদন কয়েক বারই প্রথম পাতায় প্রধান খবর হয়েছে। নাম ছড়াতে বেশি সময় লাগালো না। এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। ঢাকা ভার্সিটিতে থাকতেই শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে কার্জন হলের সামনে পুলিশের লাঠিচার্জে আমার বাম হাতের প্রথমা আংগুল কেটে ভেঙে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
তাই আমার ডান হাতের কলম সব সময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চলেছে।
তখন সাংবাদিকতার মান ভালো ছিল। দেশে পত্রিকা কম ছিল। এরশাদ পতনের প্রায় সাথে সাথেই ব্যাঙের ছাতার মত হাজার হাজার দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতে লাগলো। সমাজের একশ্রেণির টাউটবাটপাররা রাতারাতি সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদক বনে গেলো। অপরদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে সর্বত্র সরকারদলীয় লোকজনদের অনৈতিক দখলবাজি শুরু হয়ে গেল। খুব দ্রুত প্রায় হারিয়েই গেল ৯ বছরের আন্দোলনের কর্মিরা।
বঙ্গভবনে পারটাইম কাজটা করছিলাম শান্তিতে। দৈনিক পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ছিলাম। রাজনৈতিক খবরা খবর সংগ্রহই ছিল আমার কাজের অধ্যায়। সেই সুবাদে বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে যোগাযোগ ছিল। আমার বন্ধু আতাউর রহমান ছিল দৈনিক জনতা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। দেশের প্রথম শ্রেনীর একজন সাংবাদিক ছিল সে। তার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার সারাদিনের কর্মসূচী যেমন আমার জানা থাকতো, তেমনি আমারটাও তার জানা থাকতো। তখন সেলুলার ফোনের(মোবাইল)যুগ ছিলনা। আতাউর গাজীপুরের জননেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের সম্পর্কে ছোট ভাই।
একদিন আমরা দুজনেই প্রেসক্লাব থেকে পুরান ঢাকায় আখতার ভায়ের বাড়িতে গেলাম। মো. হানিফ তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আখতার ভাই সহসভাপতি। সিনিয়র নেতা, অনেক জ্ঞানি অভিজ্ঞ লোক। ক্ষমতায় বিএনপি-জামাত। তারপরও আওয়ামী লীগের অবস্থা রমরমা। এটা তাদের ভেতরে না ঢুকলে বোঝা যায় না। অনেক সময় নিয়ে আমরা দুজনে তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করলাম। দ্বিতীয় দফায় আমাদের চা দিতে এসে আখতার ভাইয়ের বউ জানালেন যে, বাইরে গোয়েন্দা বিভাগের লোক দাঁড়িয়ে আছে। ভাবি বললেন, ওরা হয়তো প্রেসক্লাব থেকেই তোমাদের পিছু নিয়েছে। ব্যাপারটা আমরা কেউ কেয়ার করলাম না। কিন্তু সবার অজান্তে আমার কপাল পুড়লো। বঙ্গভবনে রিপোর্ট গেল ইয়াহিয়া নয়ন সরকারের বিরোধীদের সাথে গোপন বৈঠক করছে। সে রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ ব্যক্তি নয়, ইত্যাদি। বিষয় আসলে কিছুই না। পেছনে লেগেছিল সেই ভুত।
সরকারদলীয় একজন সিনিয়র সাংবাদিক আমার পদে বসার জন্য গোপনে এই নাটক সাজিয়েছিল। আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের লোক বসানোর কাজে ভুতের দল সফল হয়েছিল। সপ্তাহখানিক পর আমার বঙ্গভবনের কাজটা চলে গেল।
আবার পড়লাম সাগরে। তখন ঢাকায় অনেক পত্রিকা নতুন নতুন বের হচ্ছে। পূর্ব পরিচিত এক ভদ্রলোক লোক মারফত আমাকে তার সাথে জরুরি দেখা করতো বললো। রাজধানীর দিলকুশায় তার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। তখন আমি বেকার। জানালেন, তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার অনুমোদন পেয়েছেন আমাকে দিয়ে করবেন পত্রিকাটি। পত্রিকার নাম ‘এই সপ্তাহ’। ম্যাগাজিন আকারে ৩২ পৃষ্ঠায় শুরু করলাম। আমি নির্বাহী সম্পাদক। রিপোটিংয়ের জন্য পাঁচজন নতুন ছেলে নিলাম। খুব অল্পসময়ে পত্রিকাটি বাজার চালু এবং সব মহলে গ্রহণযোগ্য প্রশংসিত হলো। এ অবস্থায় হঠাৎ করেই মালিক লেখকদের লেখার বিল, আমাদের বেতন বন্ধ করেদিলো। আমাকে অফিস দেয়া হয়েছিল পল্টনে। কথায় বলে, বড়লোকের খেয়াল ফাটা দেয়াল। তার পত্রিকা করার শখ মিটে গেছে। একদিন প্রায় সারাদিন তার চেম্বারে বসে থেকে আমার এক মাসের বেতন নিয়ে এলাম। অফিসে ফিরে সব টাকা রিপোর্টারদের ভাগবাটায়ারা করে দিলাম। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে সবাইকে বিদায় করে,চাকরি ছেড়ে দিয়ে, শূন্য পকেটে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরলাম।
ঢাকায় বাসা ভাড়া,বাজার খরচ,বড় মেয়েটা তখন এক বছর পাঁচ মাসের,তার একটা আলাদা খরচ,সব মিলিয়ে আমার দিশেহারা অবস্থা। তবে কেন জানিনা আমার ভেতরটা শক্ত হতে লাগলো। ওই পত্রিকার মালিক ছিলেন গার্মেন্স কারখানার মালিক। আমাকে গার্মেন্স কারখানার সুপারভাইজারের মত মনে করতেন। তাই চাকরিটা ছেড়ে এক রকমের শান্তি পেলাম।
এরই মধ্যে বঙ্গভবনে কিংবা রেডিওর কাজের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। একদিন সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিন চৌধুরীর সাথে দেখা করলাম। তিনি সৎ মানুষ ছিলেন। আমাকে বুঝিয়ে বললেন, তোমার বিরুদ্ধে আমার দপ্তরে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু তারপরও আমার কিছুই করার নেই। অবশ্যই তার কিছু করার নেই।

যা করার আমাকেই করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম দেশ ত্যাগ করবো। খুব গোপনে পাসপোর্ট করলাম। বাসায় আমার স্ত্রীকে, দেশের বাড়িতে আমার মাকে কাউকে জানালাম না। গোপালগঞ্জের বাড়িতে আমার শ্বশুর-শ্বশুড়ি,কাওকে কিছু বুঝতে দিলাম না। মনটা তখন আমার খুবই বিষন্ন,তার চেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ। তৎকালীন শেরাটন হোটেলের নিচে থাই এয়ার লাইন্স থেকে ব্যাংকক যাবার টিকেট কাটলাম। সবাইকে জানালাম আমি ভালো চাকরি এবং সুযোগ সুবিধা পেয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছি। আমার মেঝ ভায়রা তখন রাজবাড়ীতে, সরকারি চাকরি করতেন। এনামুল হক ফারুক, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে খুবই ভালোবসতেন। তিনি আমার উন্নত ভবিষ্যতের আশায় টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করলেন। অনেক হতাশা দুঃখ,ক্ষোভ, বেদনা নিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে পা বাড়ালাম। ভরসা ওপরওয়ালার। নিজের ওপর আস্থা,আর বুক ভরা সাহস।

১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রথম হরতাল ডেকেছিল। সেদিন ভোরে ছিল আমার ফ্লাইট। আমার আদরের মেয়ে উপমা। প্রচণ্ড বাবা ভক্ত মেয়ে। তাকে ঘুমন্ত রেখে মগবাজারের চার তলায় সিঁড়ি বেয়ে যখন নেমে আসছিলাম তখন উপমার মা পেছনে পেছনে কাঁদতে কাঁদতে নামছিল। অনেক দূর পর্যন্ত তার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তখনও সূর্য্য ওঠেনি। বাসা থেকে বের হবার আগে আমার মা জানতে চাইলেন, এভাবে হঠাৎ করে বিদেশ চলে যাবার সিদ্ধান্ত কেন নিলাম। কোনো উত্তর দিলাম না।

উপমার মা ঠিকই বুঝেছিল আমি প্রচণ্ড হতাশা-যন্ত্রণা থেকে পালাচ্ছি। যেখানে যাচ্ছি সেটাও অজানা অচেনা,অনিশ্চিত সবটুকু। কি হবে ভবিষ্যত তা বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না। সে চাপা কান্নায় শুধু জিজ্ঞেস করলো, তোমার মেয়ে সকালে উঠে যখন তার বাবাকে খুঁজবে, তখন আমি কি বলবো। এই জটিল প্রশ্নকে পেছনে রেখে সামনে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলাম। একটানে বিমানবন্দর। থাই এয়ারলাইন্সে আসন গ্রহণ এবং ব্যাংকক। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যখন বাইরে এলাম ব্যাংককের আকাশে তখন চকচকে রোদ।
-ইয়াহিয়া নয়ন

সর্বশেষ

ফেসবুক পেজ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০